দিগ্বিজয়ী গ্রিকবীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মনোবাসনা ছিল, পৃথিবীর প্রতিটি অংশকেই তিনি জয় করে নেবেন। প্রাচীনকালের ভারতবর্ষ আয়তনে ছিল বিশাল, ধনসম্পদেরও ছিল না কোনো কমতি। তাই, বাকি সকলের মতো আলেকজান্ডারেরও দৃষ্টি পড়েছিল এই ভূমির উপরে।
তবে, ভারতবর্ষের ধূসর মাটিতে তার ক্ষমতাকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করার পর সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। দাঁড় করালেন এক সেনাবাহিনী, হারালেন নন্দ রাজবংশকে। এভাবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাত ধরেই লৌহ যুগে মৌর্য রাজবংশের গোড়াপত্তন।
প্রাচীন ভারতবর্ষের পূর্বদিকে সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই মৌর্য সাম্রাজ্য। পাটলিপুত্র ছিল এর রাজধানী।
মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় চাণক্যের ভূমিকা
চাণক্যের সাথে মৌর্য সাম্রাজ্য ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও রাজ-উপদেষ্টা। সুপ্রাচীন রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ তাঁরই হাতেই রচিত। এই চাণক্য, কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও সুপরিচিত ছিলেন। চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। প্রাচীন লোককথা অনুসারে, নন্দ রাজবংশের সম্রাট ধননন্দ একবার অপমান করেছিলেন চাণক্যকে। এর প্রতিশোধ হিসেবে তিনি নন্দ সাম্রাজ্যকে ধসিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।
এরপর তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণ উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়ে বিস্তৃত করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও বিন্দুসার এই সাম্রাজ্যের মানচিত্র দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত নিয়ে গেলেও, সম্রাট অশোক কলিঙ্গ রাজ্য জয়ের মাধ্যমে সমগ্র দক্ষিণ ভারতকে মৌর্য সাম্রাজ্যের ছায়াতলে নিয়ে আসেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন স্বেচ্ছায় অবসর নিলেন তারপর মাত্র বাইশ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন তার পুত্র বিন্দুসার। অশোক তাঁর পিতার মৃত্যুর তিন বছর পরে মৌর্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আসীন হন । রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব আয়ত্ত করতে করতে তার প্রায় বছর আটেক লেগে যায়। এরপর তিনি মনোনিবেশ করেন সাম্রাজ্য বিস্তারে।
অর্থনীতি
হরেকরকম ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে তখন যুক্ত ছিল তখনকার লোকজন। সরকার এবং সাধারণ জনগণ উভয়েই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ এবং প্রজাদের থেকে খাজনা আদায়ের মাধ্যমে রাজ-কোষাগারে জমা হতো অর্থ। রাজার অধীনে থাকত জমি-জমা, বনাঞ্চল, বিভিন্ন রকমের কাঁচামাল, এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো জিনিস থাকলে তা বিক্রি করে দেওয়া হতো। অর্থ উৎপাদন, খনন, লবণ চাষ, অস্ত্র, নৌকা- এসব জিনিসের নিয়ন্ত্রণ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারে হাতে।
সেই সময় অধিকাংশ প্রজা তাদের জীবিকা নির্বাহ করত কৃষিকাজের মাধ্যমে। সেই সময় তাদের নিয়মিত কর বা খাজনা দিতে হতো। দলগুলোকে বলা হতো সমবায় সংঘ। যে রাজ্যে গিয়ে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, সেই রাজ্যও তাদের থেকে কর আদায় করত। পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার নিজে। সোনা, রূপা, এবং তামার মুদ্রা দিয়ে লেনদেন করত তারা।
পরবর্তীতে পরিশোধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে অর্থ কর্জ নেওয়ার রীতিও তখন চালু ছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যে বৃহৎ ও সুসজ্জিত এক রাস্তার অস্তিত্ব ছিল যেটা ছিল গ্রিসে যাতায়াতের সাথে সম্পৃক্ত। নিয়মিত দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো এই রাস্তার। এতে বিভিন্ন চিহ্ন ও সংকেতের মাধ্যমে দেখিয়ে দেওয়া হতো কোন জিনিস কোথায় ও কতদূর নিয়ে যেতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে গঙ্গা নদী থেকে নৌকা রওয়ানা দিত দূর শ্রীলঙ্কা, চীন ও আফ্রিকায়। জলদস্যুতা নির্মূলে সদা সচেষ্ট থাকত সরকার।
প্রশাসন
মৌর্য সাম্রাজ্যে রাজাই ছিলেন সকল ক্ষমতার মূল উৎস। তিনি নিজেই সেনাবাহিনী, বিচারপতি, আইনকানুনসহ দেশের জন্য হিতকর সিদ্ধান্ত নিতেন। তার মন্ত্রীসভায় সভাসদ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত ও দক্ষ জনবল নিযুক্ত ছিলেন। যেমন, প্রধানমন্ত্রী, হিসাবরক্ষক, কোষাধ্যক্ষ, সেনাপতি ইত্যাদি। মৌর্য সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল, যেগুলোর শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত থাকতেন রাজকুমারেরা। একেকটা প্রদেশের অধীনে থাকত বিভিন্ন গ্রাম ও শহর। শাসনকর্তা ওই এলাকার দেখভাল করতেন।
তাকে শুধু রাজার কাছে জবাবদিহি করতে হতো। তৎকালেও, চাকরির মানের ভিন্নতা ছিল। উচ্চপদে আসীন থাকা একজন নিম্ন পদের একজনের থেকে অধিক বেতন-ভাতা পেতেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রধানমন্ত্রী থেকে একজন কেরানিকে কম বেতন দেওয়া হতো। দল ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব ছিল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার।
মৌর্য সাম্রাজ্যের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কৌটিল্যের বুদ্ধিতে বিভিন্ন গুপ্তচর পুষতেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তারা বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে গোপন ও স্পর্শকাতর সকল সংবাদ এনে দিত রাজামশাইকে। এই সাম্রাজ্যের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সর্বদা বৃহৎ এক সেনাবাহিনী তৈরি থাকত এই রাজ্যে। আদেশ পাওয়া মাত্রই তারা যেকোনো কিছুর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত।
এমনকি মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশোক যুদ্ধ-বিগ্রহ থামিয়ে দেওয়ার পরেও তার কাছে ওই সেনাবাহিনী মজুদ ছিল। সৈনিকদের প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধে শামিল হয়ে প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করা। যখন কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ থাকত না, তখন তারা তাদের খেয়ালখুশি মতো যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারত।
সৈনিকেরা অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন, পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী সৈন্য, নৌবাহিনী, রথারোহী, হাতি বাহিনী, সরবরাহকারী ইত্যাদি। সৈনিকদের ভরণপোষণ এবং অস্ত্র যোগান দেওয়ার দায়িত্ব ছিল রাজার। পদাতিক সৈন্যদের কাছে থাকত তীর-ধনুক, বর্ম, বর্শা, এবং লম্বা তরবারি। অশ্বারোহীদের কাছে থাকা ঘোড়ার শরীরে কোনো জিন পড়ানো থাকত না। অস্ত্র বলতে তাদের সম্বল ছিল বর্শা এবং বর্ম।
ধর্ম
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন হিন্দু ধর্মের অনুসারী। বিন্দুসার পালন করতেন অজীবিক নামক ধর্ম। শেষ জীবনে তিনি জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার দৌহিত্র অশোক পুরো রাজ্যে বৌদ্ধধর্মের বাণী ছড়িয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন নগরী: দ্বারকা