নীলনদের তীরে গড়ে ওঠা সুপ্রাচীন এক সাম্রাজ্য: কারমা

ancient kerma civilization
কাউকে আফ্রিকা মহাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ খ্যাতি কুড়ানো সভ্যতার কথা জিজ্ঞেস করা হলে, সে সাত-পাঁচ না ভেবেই প্রশ্নোত্তরে মিশরীয় সভ্যতার বয়ান গাইবে। গাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাচীনকালে সভ্যতার উত্থান ঘটিয়ে নীলনদের তীরে শুধু মিশরীয় ফেরাউনরাই রাজ করেছে, এমনটা বলা হলে সেই বাক্যে একটু আপত্তি আছে। 

সবকিছু একপাশে রেখে প্রাচীন মিশরকে যুক্তরাজ্য হিসেবে ধরা হলে, মোট তিনটি যুগে বিভাজিত করা যাবে। প্রাচীন সাম্রাজ্য, মধ্য সাম্রাজ্য এবং নব্য-সাম্রাজ্য। মিশর শাসনকালে সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে মধ্যবর্তী সময়কালে কয়েকশ’ বছর জুড়ে বেশ কিছু দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং বিশৃঙ্খলার খবর জানা যায়। প্রাচীন মিশরের তিনটি মহান সাম্রাজ্যও নীল নদের উপর পুরোটা সময়জুড়ে সম্পূর্ণ দখলদারিত্ব স্থাপন করতে পারেনি। 

মধ্য সাম্রাজ্যের উপর বার বার আক্রমণ এসেছে দক্ষিণের প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে। এই রাজ্যের নাম হলো কারমা। রাজধানী কারমা থেকে নামকরণকৃত এই রাষ্ট্র ছিল আজকের দক্ষিণ সুদানে অবস্থিত, যার পত্তন ঘটে প্রায় ৫,৫০০ বছর পূর্বে।

kerma civilization

কারমা সভ্যতা; Image Source: Mohasin Alam Roni/MidJourney AI.

কারমা এলাকার ধ্বংসাবশেষে বহু খননকার্য ও গবেষণা চালানোর ফলে বিভিন্ন সমাধি, কবর এবং মূল শহরের আবাসিক বাসভবনগুলো আবিষ্কার করা সম্ভবপর হয়েছে। গবেষকদের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কারমা বসতিগুলোর টুকিটাকি বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে এটি মিশরীয় সভ্যতার প্রায় সমান-সমান ছিল। 

তৎকালে নুবিয়ান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরাক্রমশালী রাষ্ট্র হিসেবে কারমার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। নীলনদের উচ্চ এলাকার প্রায় ৩২২ কিলোমিটার জুড়ে ছিল তাদের বীরদর্পের আধিপত্য। তাদের রাজধানীতে সন্ধান পাওয়া বিশাল এক মন্দিরে। ওই মন্দিরে প্রাপ্ত সাংস্কৃতিক নিদর্শন দেখে বলা যায়, তা অনায়াসে ঐসময়ে মিশরের যেকোনো হস্তনির্মিত শিল্পকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখত।

সভ্যতার গোড়াপত্তন

কারমা সাম্রাজ্য গঠনের পূর্বে, এই অঞ্চল ছিল নাকাদা শাসনের অধীনে। মিশরীয় ফেরাউনদের পূর্বপুরুষ নাকাদা সম্রাটেরা নুবিয়া জয় করার পুরো নীলনদ জুড়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করতেন। এই স্বপ্ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছিল। মিশরে প্রাচীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর খ্রি.পূ. ২৪০০ অব্দ নাগাদ নীলনদের অধিকাংশ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু প্রাচীন সাম্রাজ্যের আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নীলনদের দক্ষিণ অংশের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ায়, তা হাতছাড়া হয়ে যায়। 


kerma civilization

কারমা শহরের ধ্বংসাবশেষ; Image Source: Alamy.

মিশরীয় ফেরাউনদের শাসনকালে একটি সাম্রাজ্য পতনের পর নতুন সাম্রাজ্য উত্থান পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের বেশিরভাগ ইতিহাসই লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়নি। যেগুলো রাখা হয়েছে, সেগুলো থেকে আবার পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, মিশরের প্রাচীন সাম্রাজ্য পতনের পর কারমা রাজ্য নীলনদের দক্ষিণাঞ্চল দখল করে নেয়। এই সময় মিশর মুখোমুখি হয় এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর।


মিশরে আস্তানা গাড়া নবাগত অতিথিদের মেনে নিতে হয় ফেরাউনদের। একটা সময় তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে বিভিন্ন বাণিজ্যিক বিনিময়। কৃষ্টিগত পণ্য, গয়না-গাটি ইত্যাদির সওদা হতো দুই সংস্কৃতির মধ্যে। কিন্তু হারানো ভূমির দগদগে স্মৃতির শিখা তখনও ফেরাউনদের মনে বিদ্যমান। মিশরের দক্ষিণকে তারা বহিরাগতদের দ্বারা দখলকৃত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করত। যদিও এই ভূমির মালিক সত্যিকার অর্থে মিশরীয় ফেরাউনরাই ছিল।  


মাঝেমধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত। তবে, উভয় পক্ষই একে অপরের শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিল সেই ভয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়িয়ে চলত। কেউ কারও সীমান্তে প্রবেশ করে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটিয়েছে, ইতিহাসে এমন কিছু পাওয়া যায়নি।


kerma civilization

কারমা সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত তামার ছুরি; Image Source: Wikimedia Commons.

কারমা এবং হিকসোস

একসময় কারমা রাজ্য তার বাণিজ্যিক যাত্রাপথের সুবিধা এবং আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির সম্পদের অধিগ্রহণকে কাজে লাগিয়ে সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির শীর্ষে আরোহণ করে। কিন্তু উত্তরের মিশরীয় সাম্রাজ্য তাদের কাছে ছিল শরীরে বিদ্যমান বিষফোঁড়ার ন্যায় হুমকিস্বরূপ। তাই, পথের কাঁটা সরাতে তারা এক পরিকল্পনার ছক কষেছিল। 


মিশরের তিন সাম্রাজ্যের মাঝে ছিল মধ্য সাম্রাজ্যই সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী, যার পতন শুরু হয়েছিলো খ্রি.পূ. ১৮০০ অব্দের দিকে। তবে মধ্য সাম্রাজ্যের সূর্য পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আগপর্যন্ত রাজবংশের মধ্যে বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অন্তঃকলহের কারণে ক্রমশ তা ভিতর থেকে ভেঙে পড়তে শুরু থাকে। এই সুযোগের মোক্ষম ফায়দা তুলে কারমীয়রা। 


তারা বন্ধুত্ব করে বসে সম্পূর্ণ বহিরাগত জাতিগোষ্ঠী হিকসোসদের সাথে, যারা পরবর্তীতে প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে অদ্ভুত এক রাজবংশ হিসেবে খেতাব জুটিয়েছিল। কারমা খ্রি.পূ. ১৬৫০ অব্দে  হিকসোসদের সাথে জোট গঠন করলে মিশরীয় ফারাওদের সাম্রাজ্য আক্রমণের শিকার হয় ।


মিশরীয়দের হার মানতে হয় হিকসোস এবং কারমা জোটের কাছে । এই ঘটনার সাহায্যেই প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশী ফেরাউন মিশরের সিংহাসনে আসীন হন। হিকসোসেরা তাদের নতুন রাজধানী আভারিস থেকে নীলনদের বদ্বীপ এবং মিশরের দক্ষিণাঞ্চল শাসন করছিল। ওদিকে কারমা সাম্রাজ্য নীলনদের পুরো দক্ষিণ অংশকেই নিজেদের মানচিত্রের আওতায় নিয়ে আসে। 


অপরদিকে রাজ্য হারিয়ে মিশরীয় ফেরাউনেরা একপ্রকার পঙ্গুই হয়ে গিয়েছিলেন বলা যায়। তাদের পূর্বের রাজধানী থেবেসে খানিকটা জায়গা নিয়ে কোনোরকম টিকে ছিল তারা। ঊর্ধ্ব মিশরের বাসিন্দারা কোনোরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই মেনে নিয়েছিল কারমীয়দের অনুশাসন। এর মাধ্যমেই কারমা সাম্রাজ্য তার ইতিহাসের স্বর্ণযুগে পদার্পণ করে।

 

Chakrir Prostuti

কারমা ও হিকসোস জোটের সাথে মিশরীয়দের যুদ্ধ; Image Source: Mohasin Alam Roni/MidJourney AI.

মিশরের ফেরাউনদের হটিয়ে কারমা সাম্রাজ্য এত বিশদ আধিপত্য বিস্তার করলেও আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা নিজেদের ব্যাপারে কোনো তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধ করে যায়নি। কারমা সম্পর্কে ইতিহাসবিদেরা যতটা জানতে পেরেছেন, তার পুরোটাই প্রাচীন মিশরীয় নথি থেকে, যারা কারমীয়দের নুবিয়ান বলে উল্লেখ করেছে। 


ধারণা করা হয়, শুরুর দিকে কারমা ছিল এক গ্রামীণ সংস্কৃতি, শুধু অল্পকিছু সংখ্যক লোক শহরে বাস করত। এই সময়টাতে নুবিয়ানরা কৃষিকাজ, মৎসশিকার, পশুশিকার, এবং গবাদিপশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। ধাতু এবং সিরামিক পণ্য উৎপাদনের জন্য তারা বিভিন্ন কারখানাতেও কর্মী হিসেবে নিয়োজিত ছিল।


কারমা জাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে দেফুফাস। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ভজনালয় এবং মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত মাটির ইটের তৈরি দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপত্যগুলো তাদের শৈল্পিক দক্ষতা ফুটিয়ে তোলে। দেফুফাসের দেওয়ালগুলো ঝকঝকে রঙিন চিত্র দিয়ে সাজানো ছিল। কিছু কিছু অংশ আবার গোল্ড লিফ দিয়ে খচিত ছিল। কারমা শহরের কেন্দ্রে বিশাল বড় এক মন্দির ছিল যাকে ‘পশ্চিম দেফুফা’ বলে আখ্যায়িত নাকি করা হয়েছে। 


খ্রি.পূ. ১৭০০ অব্দ নাগাদ কারমা শহরের জনসংখ্যা দুই হাজার থেকে দশ হাজারে উপনীত হয়। তাদের শিল্পশৈলীর গঠন ও ধরন মিশরীয় শিল্প থেকে ছিল খানিকটা ভিন্ন। পলিশকৃত নীল চিনামাটির পাত্রের ব্যবহার ছিল তাদের সংস্কৃতিতে। তাদের শিল্প নকশার স্বতন্ত্র ভঙ্গি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, হস্তনির্মিত শিল্পের জন্য তারা মিশরীয়দের থেকে কোনো অনুপ্রেরণা নেয়নি। কারমীয় শিল্পের পলিশ করা দামি পাথর এবং স্থাপত্যকর্ম থেকে এটাই প্রমানিত হয় যে, তারা নিজেরাই নতুন শিল্প-পদ্ধতি বের করেছিল, যেগুলোর অস্তিত্ব তাদের সংস্কৃতি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায়নি।


কারমীয়দের হাতে মজুদ ছিল দুর্ধর্ষ এক তীরন্দাজ বাহিনী, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে দক্ষ যোদ্ধার পরিচয় দিত। তবে সমস্যা হলো, কারমীয় সেনাবাহিনীর তাদের রসদের বেশিরভাগই খরচ করেছে মিশরীয়দের বিপক্ষে জয় ছিনিয়ে নিতে। কারমীয়রা যে তাদের আক্রমণে সফলতা অর্জন করেছিল, সেই প্রমান মিশর থেকে লুট করা নিদর্শনসমূহ সেই সাক্ষ্য দিলেও, মিশরীয় নথিপত্রগুলো এই ব্যাপারে চুপ ছিল।


মিশরীয় সাম্রাজ্যের মতো কারমা সাম্রাজ্যও প্রাক কারমীয় সাম্রাজ্য, মধ্য কারমীয় সাম্রাজ্য, এবং শ্রেষ্ঠ কারমীয় সাম্রাজ্য; এই তিন যুগে বিভক্ত। প্রাক কারমীয় সাম্রাজ্য চলমান ছিল খ্রি.পূ. ২৫০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ২০৫০ অব্দ পর্যন্ত। এই যুগ সম্পর্কে খুব অল্পই জানা যায়। মধ্য কারমীয় সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে খ্রি.পূ. ২০৫০ অব্দের দিকে। খ্রি.পূ. ১৭৫০ অব্দ পর্যন্ত ছিল এর স্থায়িত্বকাল। এই সময়েই কারমা ছিল মিশরের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী।


kerma civilization

কারমা অভিযানে ফেরাউন প্রথম থুতমোস; Image Source: Mohasin Alam Roni/MidJourney AI.

কারমীয় সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে খ্যাত শ্রেষ্ঠ কারমীয় সাম্রাজ্যের যুগে কারমা প্রবেশ করে হিকসোসদের মিশর জয়ের মাধ্যমে, যার স্থায়িত্বকাল ছিল খ্রি.পূ. ১৭৫০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত। এই যুগে কারমা সফলভাবে মিশরীয় নগরদুর্গ এবং দক্ষিণ নীলনদের দ্বিতীয় প্রপাতে অবস্থিত স্বর্ণখনির দখল নিতে সক্ষম হয়। এরপর খ্রি.পূ. ১৫০০ অব্দের দিকে, ফেরাউন প্রথম থুতমোসের মুখোমুখি হবার আগ পর্যন্ত তারা মিশরীয় অঞ্চলে নিজেদের রাজ্য সীমানা বিস্তৃত করতে থাকে।


থুতমোস ছিলেন আঠারোতম মিশরীয় রাজবংশের তৃতীয় ফেরাউন, যে রাজবংশকে নতুন সাম্রাজ্যের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাজবংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। নবশক্তি সঞ্চার করে, শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্ণোদ্দমে কারমায় প্রবেশের তিনি তাদের ধুলোয় মিশিয়ে দেন। এভাবেই ফেরাউন প্রথম থুতমোস মিশরের হারানো ভূমি শত্রুর হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেন। এরপর শতাব্দী জুড়ে মিশরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো দুঃসাহস আর কোনো জাতি বা সভ্যতা দেখায়নি।


আরও পড়ুন- ছাতা আবিষ্কারের অজানা ইতিহাস ।। History of Umbrella Invention

*

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন