নটবরলাল: তাজমহল বিক্রি করে দিয়েছিলো যে মানুষ

tajmahal
আজ এই আর্টিকেল এ আমি যদি আপনাদের বলি যে আমাদের সবার প্রিয় এই তাজমহল এক সময় এক বার না বরং ্তিন বার বিক্রি হয়েছিলো তাহলে আপনার কেমন মনে হবে? এই ধরনের কথা শুনে যারা যারা অবাক হয়ে বলছেন, এও কি সম্ভব? তাদের কাছে আশা করি ‘নটবরলাল’ নামটি অজানা। নটবরলাল হলেন একজন কুখ্যাত নাম যা পুরো ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল নিজের বুদ্ধি, কুটিলতা, চুরি আর লোক ঠকানোর ক্ষমতা দিয়ে।

তিন তিনবার নাকি তাজমহলের মতো অপূর্ব ও নান্দনিক স্থাপত্যকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন এই ব্যক্তি। কথা বলার ধরন এবং লোক ঠকানোর নতুন নতুন চক্রান্তে নিজেকে প্রায় অধরা করে তুলেছিলেন। অনেকবার ধরা পড়ার পরও বারবার জেল পালিয়েছেন সুচারু পরিকল্পনায়। জানার ইচ্ছে হচ্ছে নিশ্চয়ই, কে ছিলেন এই নটবর? কী করেই বা তাজমহল বিক্রির মতো অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনি?

তাজমহলের সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন এক মার্কিন নবদম্পতি। এই অপার্থিব সৌন্দর্যের আট কাহন শুনছেন আর ভাবছেন এই তাজমহল যদি নিজেদের হতো। নিজেরাই যদি এই সৌন্দর্যের দাবিদার হতে পারতেন! ভালবাসার এই অমর চিহ্ন যদি নিজের নামে করা যেত।


natwarlal

তাজমহল, লালকেল্লা, সংসদভবন সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন

হঠাৎ পেছন থেকে একজন মানুষের কণ্ঠ ভেসে আসল, “চাইলেই আপনি হতে পারেন এই পুরো তাজমহলের সম্পূর্ণ ভাগিদার! সামান্য কৌতূহলে বসে জিজ্ঞেস করা, “কি করে? এটাও কি সম্ভব?” অমনি মখমলি পসরা সাজানো বিছানায় নটবরলালের বিচক্ষণ পদচারণ। উত্তরে, “আপনার স্বামী চাইলেই কিনে নিতে পারে এই পুরো তাজমহল। আমি ভারত সরকারের সরকারি কর্মচারি। আমাদের মতো আরো কয়েকজনের হাতে এই তাজমহল বিক্রির দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে। আর সেই মোতাবেক আমরা কাজ করছি।”


বিষয় টা শুনতে খটকা লাগলেও, মনের মধ্যে তো পুরো তাজমহলকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু খটকা থাকলে সেটা তো দূর করতে হয়। তাই আগেই জিজ্ঞেস করে নেয়াই ভাল যে, “আপনাদের সরকার এই তাজমহল কেন বিক্রি করতে চাইছেন বলুন তো?” উত্তর এলো, “আমাদের সরকারের গরীবি অবস্থার কথা  কারও তো আর অজানা নয়।  আশে পাশে দেখুন কতো খেতে না পাওয়া মানুষজন। এই অনাহারে থাকা লোকগুলোর খাওয়ার যোগাতেই আমাদের সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার উপর হাজার হাজার টাকা খরচ করে এই তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণ করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?”


এই উত্তরেই গলে গেল নব দম্পতি। হাতে রয়েছে টাকা আর দেরি কেন? হানিমুন এ এসে এর চাইতে ভালো উপহার আর কী-ই বা হতে পারে? তারা কিনে নিলেন তাজমহল, আর বাঘ তার শিকার ধরে পেটপূজো করে হাওয়া।


ঠগবাজ শিরোমণি নটবরলাল

ঠগবাজ শিরোমণি নটবরলাল

আর আপনারা এই গল্প শুনলে অনেকেই হয়তো বলবেন যে এটা হয় তো কোনো আজগুবি গল্প, “আরে, এটা কখনো হতে পারে নাকি? এতো বোকা মানুষ কিভাবে হতে পারে?” কিন্তু বাস্তব নটবরলাল এই ধরনের কারসাজি শুধু একবার নয়, তিন তিনবার করেছেন তাজমহল বিক্রেতা ঠগ শিরোমণি। শুধু ক্রেতাদের বোকামি বললে নটবরলালকে হয় তো ছোট করে দেখানো হবে। 


তার কথায় এমন কারসাজি, বিভিন্ন কৌতুহল দমনের জন্য তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা যে কারও উপর খুব সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন তিনি। আর সেই কারণে শুধু কি তাজমহল? ৫৪৫ জন সাংসদসহ পুরো সংসদভবন, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতিভবন এ সবকিছু বিক্রি করেছিলেন তিনি চড়া দামে বিভিন্ন খদ্দরের কাছে। শুধু সাধারণ মানুষই নন টাটা, বিরলা , অম্বানি মিত্তলও এই ঠগবাজের শিকার। এভাবেই দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ এই নটবরলালের দুষ্কৃতির শিকার।


তাহলে চলুন জানা যাক কে এই নটবরলাল? বিহারের সিওয়ান জেলার বানগ্রা গ্রামে ১৯১২ সালে নটবরলালের জন্ম। তার আসল নাম কিন্তু নটবরলাল নয়। মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব হলো তার প্রকৃত নাম। ছেলেবেলা থেকেই নটবরলালের একটি বিশেষ গুণ ছিল। আর সেটি হলো অন্যের সই নিখুঁত ভাবে জাল করা।


তার প্রথম চুরির ঘটনাটাও বেশ মজার। গ্রামের এক বৃদ্ধ  তাকে শহরে ব্যাংক থেকে চেকে সই দিয়ে টাকা উঠানোর জন্য পাঠাতেন। একদিন মিথিলেশ এর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মিথিলেশ চেক বইয়ের কয়েকটা পাতা চুরি করে নিল। ব্যাংকে সই নকল করে ১,০০০ টাকার চেক লিখল এবং একটু ভয়ে ভয়ে ব্যাংকে জমা দিল। আশাতীতভাবে সেই চেক ব্যাংকে গ্রহণ করল এবং তাকে এক হাজার টাকা দিল। এই তার অপরাধজীবনের শুরু।


Natwarlal

দেখতে খুব একটা আলাদা করে বলার মতো কিছু নয়। সাদা মাটা আর পাঁচটা লোকের মতোই তিনি। তা হলেও বুদ্ধি আর চতুরিতে তার জুড়ি মেলা ভার। তার নটবরলাল হয়ে ওঠার গল্পটাও বিচিত্র।


মিথিলেশ যখন ঠগবাজি শুরু করে তখন তার এক সাগরেদ ছিল, তার নাম নটবরলাল। একদিন কিছু সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যায় মিথিলেশ, কিন্তু তার সাগরেদ পালিয়ে যায়।  তখন থেকেই মিথিলেশ নিজেকে নটবরলাল নামে পরিচয় দেয়া শুরু করে আর তার পালিয়ে যাওয়া বন্ধুর পরামর্শেই ঠগবাজি করত বলে জানা যায়। সেই থেকে মিথিলেশ ‘নটবরলাল’ নামেই পরিচিত হয়। 


natwarlal

কয়েদি নটবরলাল

নটবরলাল সেই সময় ঠগবাজি করে প্রচুর অর্থ সম্পত্তির মালিক হয়। বড়ো বড়ো গোয়েন্দা, অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ঘোল খাওয়ানো এই নটবরলালের কাছে কোন ব্যাপার ছিল না। এটা যেন তার নেশা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশদের পর্যন্ত তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। আর এই নেশাই তাকে তার ওকালতি পেশা থেকে স্থায়ীভাবে এই ঠগবাজি পেশায় আনতে বাধ্য করে।


তার এই ঠগবাজি জীবন যে একেবারে সরলভাবে চলছিল তা কিন্তু নয়। অনেক ঘাত প্রতিঘাতও পোহাতে হয়েছিল তাকে। অন্তত ১০০টি  প্রতারণার কেস ও জোচ্চুরির মামলায় ৮টি রাজ্যের বিশাল পুলিশ বাহিনী নটবরলালের পিছনে পড়েছিল। সে জীবনে যত ঠকবাজি করেছে সব মামলা মিলিয়ে তার সাজার মেয়াদ হয় ১১৩ বছর। কিন্তু নটবরলালের তাতে বয়েই গেছে আদালতের রায় মেনে নিয়ে জেলের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে।


পুলিশ আর জেলারদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৯ বার ধরা পড়েও জেল ভেঙে পালিয়েছে এই নটবর, চলে গিয়েছে পুলিশের নাগালের বাইরে। ফের ধরা পড়েছে, ফের পালিয়েছে। জেল ভাঙা যেন তার কাছে কোনও ব্যাপারই না। সর্বসাকুল্যে ১১৩ বছরের জেলের পরিবর্তে শুধুমাত্র ২০ বছরের মতো জেল জীবন কাটাতে হয়েছিল তাকে।


natwarlal

জেলে বন্দী নটবরলাল

বয়স বাড়ার ফলে অনেকে ভেবেছিল বুড়ো হয়ে গেছে নটবর। তার বুদ্ধিতে নাকি জং ধরে গিয়েছে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়ই নি, সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯৯৬ সালে ৮৪ বছর বয়সে নটবরলাল ধরা পড়েছিল। অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে থাকার অনুমতি জোগাড় করে নটবরলাল। কানপুর জেল থেকে হুইল চেয়ারে পুলিশ পাহারায় ‘অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সে’ যাওয়ার মাঝেই ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গিয়েছিল ঠগ শিরোমনি। সেই শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিল। আর দেখা যায়নি নটবরলালকে!


পরিবারের দাবি তার মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বাস করতে পারেনি পুলিশ। তবে আর দেখাও যায়নি নটবরলালকে। ২০০৯ সালে তার উকিল আদালতে আবেদন দাখিল করেন যেন নটবরলালের নামে সকল মামলা তুলে নেয়া হয়।


 তিনি আরও উল্লেখ করেন ঐ বছরের জুলাইয়ের ২৫ তারিখ নটবরের মৃত্যু হয়। যদিও তার ভাই গঙ্গা প্রসাদ শ্রীবাস্তব দাবি করেন ১৯৯৬ সালেই নটবরের মৃত্যু হয়। তাই তার মৃত্যু নিয়ে এখনও রয়ে গেছে বিশাল রহস্য। তার ভাই বর্তমানে বিহারের গোপালগঞ্জে বাস করেন। নটবরের এক মেয়ে আছে যিনি একজন সিপাহীকে বিয়ে করেন।


অপরাধ জগত নিয়ে গবেষকদের কাছে নটবরলাল চূড়ান্ত কৌতূহলের কেন্দ্র। কোন জাদুতে সে লোক ঠকিয়ে তাজমহল, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন ও সংসদ ভবন বিক্রি করে মোটা টাকা রোজগার করেছিল তা-ও এক অবাক কান্ড। নটবরলালের নাম নিয়ে হিন্দিতে দুটো সিনেমাও হয়েছে। একটিতে অমিতাভ বচ্চন এবং অন্যটিতে ইমরান হাশমি অভিনয় করেন।


natwarlal


নটবরলালের চুরিগুলোর ধারণা বিভিন্ন সিনেমায় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবচাইতে মজার ব্যাপার এতো বড় নাটের গুরু, যার চালাকি ও বুদ্ধিতে বাঘা বাঘা লোকজন থেকে অনেকেই তটস্থ থাকত, এই ধরনের একজনকে তার গ্রামের লোকজন কিন্তু পর করে দেয়নি। গ্রামের লোকজন সকলেই নটবরের স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলার ব্যাপারে খুব সচেষ্ট। 


তারা নটবরকে নিয়ে রীতিমত গর্ব করে। প্রতারণার ধরনের কারণে তাকে অনেকসময় ‘ফ্র্যাঙ্ক অ্যাবাগনেল’ এবং ‘ভিক্টর লুস্টিগ’-এর সাথে তুলনা করা হয়। প্রকৃত অর্থেই নটবর ছিল তার সময়ের চোরদের মধ্যে সেরাদের সেরা।


আরও পড়ুন- জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় সিন্ধু সভ্যতার অবদান

*

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন