নাৎসি বাহিনীর নেতা ও স্বৈরশাসক এডলফ হিটলার ইতিহাসের এক ঘৃণিত রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পেলেও তার আরও একটি পরিচয় অনেকের কাছেই প্রায় অজানা। রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে থেকেই তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলেন একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে। অল্প বয়সেই ছবি আঁকতে ও কবিতা লিখতে ভালবাসতেন। তার বিখ্যাত বই ‘মাইন ক্যাম্ফ’ এ তার শিল্পী জীবনের নানা গল্প উঠে এসেছে।
১৯০৭ সালে ১৮ বছর বয়সে চিত্রাঙ্কন শিখার জন্য ভিয়েনার বিখ্যাত একাডেমি অব ফাইন আর্টসে ভর্তির হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরপর দুবার ভর্তি পরীক্ষায় বসেও হিটলার উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তিনি যে ছবিগুলো এঁকেছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তা পরীক্ষকদের মনে দাগ কাঁটতে পারেনি।
তার ছবিগুলো দেখে পরীক্ষকরা বলেছিলেন, অঙ্কনশিল্পের জন্য হিটলার উপযুক্ত নন। সে সময় সহানুভূতিশীল একজন পরীক্ষক তাকে জানান, চিত্রকলার চেয়ে আর্কিটেকচারে তার প্রতিভা দেখানোর সুযোগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে। এজন্য তিনি হিটলারকে সেখানকার একাডেমি অফ আর্কিটেকচারে আবেদন করার পরামর্শ দেন। তবে সেখানে ভর্তি হতে গেলে হিটলারকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কিন্তু হিটলার লেখাপড়ায় ভাল না হওয়ায় মাধ্যমিক পরীক্ষার গন্ডিই পেরোতে পারেননি।
ভিয়েনার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে পারেন নি বলে তিনি হতাশা ও মানসিক চাপে প্রায় পাঁচ বছর আত্মগোপন করে ছিলেন। হিটলারের পরবর্তী জীবন দেখলে বোঝাই যায় যে তিনি অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে একজন সফল চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হিটলার খুব একটা যে সফল হননি।
এরপর হিটলার ভিয়েনা ছেড়ে মিউনিখে এসে উপস্থিত হন। চারদিকে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। হিটলার জার্মানির পক্ষে সে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ শেষে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ন্যাশনাল ওয়াকার্স পার্টির প্রধান হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। পরে সেই দল ভেঙে ন্যাশনাল স্যোশালিস্ট পার্টি নামে নিজের একটি দল করেন। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন।
দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে নাৎসি স্বৈরশাসনের জন্ম দেন। তার নির্দেশে নির্বিচারে ইহুদীদের হত্যা করা হয়। ইউরোপে একের পর এক দেশ দখল করে নিতে থাকেন। তার কারণে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতির মূল হোতা হয়ে উঠেন এই নেতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পরাজয় ও মৃত্যুর পর তার আঁকা অনেক শিল্পকর্ম আমেরিকান সৈন্যরা নিয়ে যায়। সেসব শিল্পকর্মের অধিকাংশই আমেরিকার সরকারের হেফাজতে আছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। এসব শিল্পকর্ম কখনো জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয়নি। পরবর্তীকালে হিটলারের আঁকা কয়েকশ ছবি উদ্ধার হয়। হিটলারের চিত্রকর্মের কয়েকটি ম্যাসাচুসেটসের নাটিকের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আন্তর্জাতিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এসব চিত্রকর্মের কোনোটা জলরঙের, কোনোটা আবার তেলরঙে আঁকা।
এখনও পর্যন্ত হিটলারের কয়েকশ চিত্রকর্মের হদিশ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ছবিই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যক্তির সংগ্রহে রয়ে গেছে। পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা হিটলারের অনেকগুলো চিত্রকর্ম নিলামে তোলা হয় এবং তা বেশ ভাল দামে বিক্রিও হয়।
হিটলারের চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি চিত্রকর্ম ছিল মিউনিখ টাউন হলের। জলরঙে আঁকা ১৯১৪ সালের মিউনিখ শহরের পুরোনো রেজিস্ট্রি অফিসের চিত্রকর্মটি ২০১৪ সালে জার্মানির নুরেমবার্গের ভাইল্ডার অকশন হাউস থেকে প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার ইউরোতে বিক্রি হয়। ২০১৫ সালে নুরেমবার্গের আর একটি নিলামে হিটলারের ১৪টি ছবি প্রায় ৪ লক্ষ ইউরোতে বিক্রি হয়। অকশানে নিলামকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে হিটলারের ছবিগুলোকে ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে তুলে ধরা হয়।
বাকি চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে গ্রাম্য রাস্তার দৃশ্য, অস্ট্রিয়ার ডার্নস্টেইন শহরের প্রবেশ পথের ছবি, আলপাইন ফুলের বোকে এবং অন্যটি ফুল, ফল ও ঘড়ির ছবি অঙ্কিত চিত্রকর্ম। এই চিত্রকর্মগুলোওে নিলামে বেশ ভাল দামেই বিক্রি হয়। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত হিটলার হাজারের উপর ছবি এঁকেছিলেন।
তবে এ সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। গবেষকদের কারও কারও অভিমত, হিটলার তার জীবনকালে কেবলমাত্র ৩০০টির মতো চিত্রকর্ম সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। তবে হিটলার তার বই ‘মাইন ক্যাম্ফে’ উল্লেখ করেন, ভিয়েনায় থাকাকালে তিনি কোনো কোনো দিন দুই-তিনটি চিত্রকর্মও তৈরি করতেন। তাই ছবির সংখ্যা ৬০০ এর অধিক হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
পিটার জন নামের এক গবেষক, যিনি হিটলারের খুব কাছের লোক ছিলেন তার এক লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছরে ভিয়েনা ও মিউনিখে অবস্থানকালে হিটলার প্রায় এক হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন, যেখানে জল রঙে আঁকা ছবির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি।
১৯৩৮ সালে জার্মানি যখন অস্ট্রিয়া অধিকার করে তখন হিটলার ভিয়েনায় থাকার সময়ে তার আঁকা চিত্রকর্মগুলো উদ্ধারের জন্য জনকে দায়িত্ব দেন এবং সেসব চিত্রকর্ম নষ্ট করে ফেলার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু কী কারণে হিটলার তার চিত্রকর্মগুলোকে নষ্ট করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
১৯৩৭ সালে সালে পিটার জন ভিয়েনায় অবস্থিত জার্মান দূতাবাসের আর্ট কনসালট্যান্ট নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি হিটলারে আরও অনেক চিত্রকর্মের সন্ধান পান। কিছু ছবি নষ্ট করে ফেললেও জন হিটলারের বেশ কিছু ছবি নিজের সংগ্রহে রেখে দেন। পরবর্তীকালে হিটলারের মৃত্যুর পর জন হিটলারের বেশকিছু চিত্রকর্ম বিক্রি করেন যার গড় মূল্য ৫০ হাজার ডলারেরও বেশি।
হিটলারের আঁকা চিত্রকর্মগুলোর আসলেই কি কোনো শিল্পমান রয়েছে? এ প্রসঙ্গে সমালোচক জন গুন্থারের বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৬ সালে ভিয়েনা আর্ট একাডেমিতে সংরক্ষিত হিটলারের আঁকা চিত্রকর্মগুলো দেখার পরে এ চিত্রসমালোচক বলেছিলেন,
“ছবিগুলো গতানুগতিক। শিল্পের যে একটা ছন্দ থাকে তা ছবিগুলোতে খুব একটা দৃশ্যমান নয়। তাছাড়া রঙের ব্যবহার এবং চিত্রকর্মে দার্শনিক কোনও চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় না।”
তবে ২০০২ সালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মডার্ন আর্ট ক্রিটিক হিটলারের ছবিগুলো সম্পর্কে জানান যে, ছবিগুলো কে এঁকেছেন তা না জেনে যদি চিত্রকর্মগুলোর মূল্যায়ন করা হতো তাহলে অন্যরকম ব্যাখ্যাও হয়তো পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে চিত্রশিল্পী হিটলারের চেয়ে তার অন্ধকার দিকটি সমালোচকদের আকর্ষণ করেছে সবচেয়ে বেশি বলে তিনি মনে করেন। কাজেই সমালোচকদের মধ্যেও যে হিটলারের চিত্রকর্ম নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।